স্ট্রোক: কারণ, প্রভাব এবং ফিজিওথেরাপির ভূমিকা :
স্ট্রোক একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যা হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হলে ঘটে। এটি আমাদের দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। স্ট্রোকের পর সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা না পেলে এটি শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক দিক থেকে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
স্ট্রোক কী এবং এটি কেন ঘটে?
স্ট্রোক মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
1. ইস্কেমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke): এটি সবচেয়ে সাধারণ স্ট্রোক, যেখানে মস্তিষ্কের রক্তনালীতে ব্লকেজ তৈরি হয়, ফলে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে রক্ত এবং অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না।
2. হেমোরেজিক স্ট্রোক (Hemorrhagic Stroke): এটি তখন ঘটে যখন মস্তিষ্কের ভেতরে কোনো রক্তনালী ফেটে যায় এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।
স্ট্রোকের প্রধান কারণসমূহ :
বাংলাদেশে স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধির পেছনে কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে:
1. উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension): এটি স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ। আমাদের দেশে অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে সচেতন নয় এবং এর নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করে না।
2. ডায়াবেটিস (Diabetes): নিয়ন্ত্রিত না হলে ডায়াবেটিস স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
3. ধূমপান এবং অ্যালকোহল সেবন: এগুলো রক্তনালীর ক্ষতি করতে পারে, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
4. উচ্চ কোলেস্টেরল: অতিরিক্ত কোলেস্টেরল রক্তনালীগুলোতে ফ্যাটি ডিপোজিট তৈরি করে, যা রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
5. অনিয়মিত জীবনযাপন: পর্যাপ্ত ব্যায়ামের অভাব, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, এবং মানসিক চাপও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশে স্ট্রোকের প্রভাব :
বাংলাদেশে স্ট্রোকের প্রভাব ব্যাপক এবং বিপর্যয়কর হতে পারে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে চিকিৎসা সেবার অভাব রয়েছে, সেখানে স্ট্রোকের পর যথাযথ পুনর্বাসন পরিষেবা পাওয়া কঠিন। স্ট্রোকের ফলে অনেক রোগী চলাফেরা করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, যেটি তাদের জীবনের মানকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়।
ফিজিওথেরাপি: স্ট্রোকের পরে পুনর্বাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় :
স্ট্রোকের পরে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি না শুধুমাত্র শারীরিক কার্যকলাপ পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে, বরং মানসিক ও সামাজিক পুনর্বাসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
1. মোটর স্কিল পুনরুদ্ধার: স্ট্রোকের ফলে শরীরের একপাশে বা পুরো শরীরে পক্ষাঘাত ঘটতে পারে। ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে এই পেশিগুলোর ক্ষমতা ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করা যায়।
2. ভারসাম্য ও সমন্বয় (Balance and Coordination): ফিজিওথেরাপি ব্যালেন্স এবং সমন্বয় উন্নত করতে সহায়তা করে, যা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়।
3. মোবিলিটি উন্নতি: ফিজিওথেরাপি সেশনগুলোর মাধ্যমে হাঁটা, বসা, এবং ওঠা-নামার মতো কার্যক্রমগুলো ধীরে ধীরে পুনরায় শিখানো হয়।
4. নিউরোপ্লাস্টিসিটি (Neuroplasticity): ফিজিওথেরাপি নিউরোপ্লাস্টিসিটিকে উদ্দীপ্ত করে, যা মস্তিষ্কের সুস্থ অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত অংশের কাজ নিতে সহায়তা করে।
5. মানসিক সাপোর্ট: স্ট্রোকের পরে মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফিজিওথেরাপিস্টের সাথে নিয়মিত কাজ করা রোগীর আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়।
বাংলাদেশে স্ট্রোক ব্যবস্থাপনা ও চ্যালেঞ্জ :
বাংলাদেশে স্ট্রোকের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম যথেষ্ট উন্নত হলেও চ্যালেঞ্জ এখনও প্রচুর। বিশেষ করে, ফিজিওথেরাপি সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুলভ নয়। তবে, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক প্রশিক্ষিত ফিজিওথেরাপিস্টের সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।
স্ট্রোক এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যা প্রয়োজনীয় সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে আমাদের উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা। আর যদি স্ট্রোক হয়ে যায়, তবে যত দ্রুত সম্ভব ফিজিওথেরাপি শুরু করা উচিত। কারণ, সঠিক পুনর্বাসনই একজন স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীকে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে।